কোটা: ঢাবি ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ-ভাংচুর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের সঙ্গে সরকারি চাকরির কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2013, 11:36 PM
Updated : 12 July 2013, 00:24 AM

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও কার্যালয়, প্রক্টর কার্যালয়, সমাজ বিজ্ঞান ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর চালানোর পাশাপাশি পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ পুড়িয়ে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। বেশ কিছু যানবাহনও ভাংচুরের শিকার হয়েছে। 

ভাংচুরের ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সংঘর্ষ চলাকালে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে ১২ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

বিরোধী দল বিএনপি আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি দিয়েছে। তবে এই আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ ও ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নামের দুটি সংগঠন।

৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল বাতিলের দাবিতে একদল পরীক্ষার্থী বুধবার দিনভর শাহবাগ অবরোধ করে রাখলে যানজটে নাকাল হতে হয় রাজধানীবাসীকে। 

তাদের আন্দোলনের মুখে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) ওই ফল পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত জানালেও আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধাসহ সব কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ‘বঞ্চিত শিক্ষার্থী’ ব্যানারে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে রওনা হয়। তবে শাহবাগ মোড়ে আগে থেকেই অবস্থান নেয়া পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে ও লাঠিপেটা করে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেয়।

এরপর চারুকলা অনুষদের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে ইট ছুড়তে থাকে; সড়কে কাঠ ও কাগজ জড়ো করে আগুনও জ্বালায় তারা। এ সময় সব কোটা বাতিলের দাবিতে তাদের স্লোগান দিতে দেখা যায়।

এক পর্যায়ে পুলিশ শাহবাগ থানার সামনে থেকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে ছুড়তে এগোতে থাকে। বিক্ষোভকারীরাও টিএসসি থেকে নজরুল সমাধি কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে ঢিল ছোড়া চালিয়ে যায়।

এ সময় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে আন্দোলনকারীরা। চারুকলার সামনে এটিএন বাংলার একটি গাড়িও তাদের রোষের শিকার হয়। মাথায় আঘাত পান গাড়ির চালক।

বেলা সোয়া ১২টার দিকে আন্দোলনকারীরা রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে আবারো শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের দিকে এগিয়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছিয়ে এসে নাটমণ্ডলের সামনে থাকা গত পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ রাস্তায় এনে অবরোধ করে। পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়তে থাকলে আন্দোলকারীরা শোলার পাখিসহ কয়েকটি মোটিফে আগুন দেয়।

তাদের হটানো সম্ভব না হওয়ায় পুলিশ সাঁজোয়া যানে করে শাহবাগ থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্ত্বরের দিকে এগোয়। এ সময় হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।

এ সময় পুলিশের তৎপরতায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। তাদের একটি অংশ সংগঠিত হয়ে উপাচার্যের বাসভবনে এবং আরেক দল উপাচার্যের কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা করে। এর মধ্যে প্রক্টরের কার্যালয়েও ঢিল ছোড়া হয়।

এ সময় ছাত্রলীগের একদল কর্মী আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে ‘শিবিরকর্মী’ সন্দেহে মারধরও করা হয়।

ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা এরপর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জড়ো হয় এবং গেট ভেঙে ভেতরে খোলা জায়গায় বিভিন্ন অংশে ভাঙচুর চালায়। উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ সময় প্রশাসিনক ভবনের অফিসে ছিলেন।

সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হন এনামুল, সৃজন, আনোয়ার ও জহির নামের চার আন্দোলনকারী। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা চারজনই ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

এছাড়া সংঘর্ষে আহত নূরনবী মণ্ডল (বাংলা ৩য় বর্ষ), ফয়সাল আহমেদ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চতুর্থ বর্ষ), মোস্তাফিজুর রহমান (শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ),  সজীব (দর্শন, প্রথম বর্ষ), আবু সালেম (দর্শন, প্রথম বর্ষ), আফতাম (মার্কেটিং), মাহিন (এ এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র), শরীফ (জহুরুল হক হল), কামরুল ও আলামিন (মুহুসিন হল), প্রদীপ কুমারকে (জগন্নাথ হল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসে আরো বহু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

দফায় দফায় সংঘর্ষের এক পর্যায়ে রোকেয়া হল ও উপাচার্যের বাসভবনের মাঝামাঝি এলাকায় পুলিশের একটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভাংচুরের শিকার হয় বেশ কয়েকটি অটো রিকশা। 

শাহবাগে রওনা হওয়ার আগে বিক্ষোভকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দেয়। তারা সেখানে ডেইলি স্টারের কয়েকটি কপিও পোড়ায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম আলো পোড়ানো হয়।

প্রথম দিন এ আন্দোলনে সমর্থন দিলেও বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়ি ও প্রক্টরের কার্যালয়ে হামলার পর ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, “এই আন্দোলন দাবি আদায়ের জন্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য।”

তিনি বলেন, “গতকাল যে দাবি ছিল তাতে আমি সমর্থন দিয়েছি এবং পিএসসি তা সংশোধনও করেছে। এখন আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে জামায়াত-শিবির হামলা চালাচ্ছে। উপাচার্যের বাসভবন ভাংচুর, প্রক্টর অফিস ভাংচুর তারই প্রমাণ দেয়।”

সাংবাদিকেদের প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর বলেন, “শুরুতে পুলিশ আমাদের অনুমতি ছাড়াই টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছে। পরে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালালে আমি তাদের (পুলিশ) ডেকে আনি।”

কোটারিবোধী আন্দোলনের সমালোচনা করে  ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এক বিবৃতিতে বলেছে, “যারা মুক্তিযোদ্ধা ও নারী কোটা বাতিল চায় তারা সাধারণ ছাত্রের নামধারী জামায়াতের দোসর।”

সাধারণ ছাত্রের লেবাসে ‘শিবিরের নেতাকর্মী এবং পশ্চাৎপদশীল কিছু লোক’ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন, জাসদ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের জোট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় ইন্ধন দিয়েছে জামায়াত-শিবির।

অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘সরকার তাদের অপশাসনের ফলস্বরূপ জনবিস্ফোরণ দেখে এতোটাই বেসামাল হয়ে গেছে যে, বিরোধী দলকে দমনের পাশাপাশি কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া বিবেচনায় না এনে তাদের ওপর পুলিশ এবং যুবলীগ ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে।”

বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে রাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনকে ‘মেধাশূন্য করার এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করছে বিএনপি

মির্জা ফখরুল বলেন,  “এটা শুধু সরকার ন?য়, গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। আমরা তাদের দাবি বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।”

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভাংচুরের ঘটনায় একটি মামলা করেছে কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যারয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসএম কামরুল আহসান বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ শতাধিক তরুণের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার এস এম শিবলী নোমান সাংবাদিকদের জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা ১২ জনকে আটক করেছেন। তাদের শাহবাগ থানায় রাখা হয়েছে।

এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও একদল শিক্ষার্থী এসে এই বিক্ষোভে যোগ দেয়।

কোটা বাতিলের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এদিন যার যার বিশ্বাবিদ্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়। মানববন্ধন করে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

১৯৭২ সালে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মাত্র ২০% ছিল মেধা কোটা, ৪০% ছিল জেলা কোটা, ৩০% ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০% ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা।

১৯৭৬ সালে এই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০%, আর জেলা কোটায় ২০%। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আগের মতোই ৩০% পদ রাখা হয়।

১৯৮৫ সালে এ ব্যবস্থা আবারো বদলানো হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫% পদ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০%, নারীদের জন্যে ১০% এবং প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্যে ৫% পদ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়।

পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।   

বিসিএসসহ সব পাবলিক পরীক্ষার কোটা পদ্ধতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাতিলের দাবিতে ইতোমধ্যে সরকারকে উকিল নোটিস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।

তিনি বলেন, “২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে মন্ত্রী পরিষদ সচিব, সংস্থাপন সচিব ও শিক্ষা সচিব ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিবকে নোটিসটি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কোটা বাতিল না করলে আগামী শনিবার হাই কোর্টে রিট করা হবে।”